স্বাধীনতার ৫০ বছরেও শহীদের স্বীকৃতি পায়নি বঙ্গবন্ধুর সহচর গোবিন্দগঞ্জের তিন কৃতি সন্তান

আল কাদরি কিবরিয়া সবুজ, (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি
আল কাদরি কিবরিয়া সবুজ, (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি আল কাদরি কিবরিয়া সবুজ, (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ৯:৪৮ অপরাহ্ন, ০৫ অগাস্ট ২০২১ | আপডেট: ৯:৪৮ অপরাহ্ন, ০৫ অগাস্ট ২০২১

মহান স্বাধীনতার ৫০ বছরেও শহীদদের স্বীকৃতি পাননি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জের কৃতি সন্তান বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর এমাদ উদ্দিন আকন্দ, আব্দুল কাদের সরকার, সোবাহান আকন্দ। এইতিন কৃতি সন্তান সার্বিক সহযোগীতায় ১৯৬৯ সালে মহিমাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তৎকালিন সময়ে আওয়ামীলীগের উদ্যোগে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।

এ জনসভায় প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন, ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই বঙ্গবন্ধুর জনসভার ফলশ্রুতিতে বিপুল ভোটে বাংলাদেশের প্রথম স্পিকার শাহ আব্দুল হামিদ বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর এমাদ উদ্দিন আকন্দ, আব্দুল কাদের সরকার, সোবাহান আকন্দ মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার জন্য অর্থ, খাবারসহ সার্বিক সহযোগীতা দিয়ে স্থানীয় ভাবে মুক্তিকামী লোকদের সুসংগঠিত করতে থাকেন।

এতে তারা স্থানীয় রাজাকার-আলবদরদের টার্গেটে পরিনত হন। তৎকালিন শান্তিকমিটি ৩ আগষ্ট ১৯৭১ইং সালে সকালে রাজাকার ও পাক বাহীনি মহিমাগঞ্জ আলিয়া কামিল মাদ্রাসা মাঠ, রেলওয়ে ষ্টেশন ও রংপুর সুগার মিল গেষ্ট হাউজে ক্যাম্প করে করফিউ জারি করে। ওই দিন বিকালে স্থানীয় রাজাকাররা মিলে পাক হানাদার বাহিনী মহিমাগঞ্জ বাজারে অমুল্য কর্মকারকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে।

এরপরে বঙ্গবন্ধুর সহচর এমাদ উদ্দিন আকন্দ, আব্দুল কাদের সরকার ও সোবাহান আকন্দকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে পাশ্ববর্তী শিবপুর ইউনিয়নের মালঞ্চা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে পাক হানাদার বাহীনি ও রাজাকাররা মিলে নির্মম ভাবে গুলি করে হত্যা করে। শুধু তাই নয় স্থানীয় মহিমাগঞ্জ বাজারের একটি হিন্দু পরিবার বরেন্দ্র নাথের মেয়েকে তুলে নিয়ে পাক হানাদাররা ধর্ষন করে। সে সময় মেয়েটি লজ্জায় আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এই বীরঙ্গনা নারী তার পর থেকে আত্মগোপনে থেকে ভারতে পাড়ি জমান।

এর পর পরবর্তীতে জেলা পরিষদের মাধ্যমে শহীদদের গণকবরের স্থানে শহীদ ফলক স্থাপন করেন। এরপর স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ বে-সরকারী সংগঠন অধ্যাপক সমিতির সহযোগীতায় শহীদ এমাদ উদ্দিন আকন্দের নামে ডাক বাংলো টু মহিমাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় সড়ক, শহীদ সোবাহান আকন্দের নামে সোনারপাড়া টু সোনাতলা সড়ক ও শহীদ আব্দুল কাদের সরকারের নামে মহিমাগঞ্জ রিক্সাস্ট্যান্ড টু মহিমাগঞ্জ আলিয়া মাদ্রাসা সড়কের নামকরন সহ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়।

পরবর্তীতে এই শহীদদের পরিবারের উদ্যোগে মালঞ্চা থেকে মহিমাগঞ্জে গণকবর স্থানান্তর করা হয়। এবং সম্প্রতি আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইবুনালের সদস্যরা মহিমাগঞ্জে এসে এই শহীদ পরিবারগুলি ও এলাকাবাসীর সাক্ষ্য গ্রহন করেন। সেই যুদ্ধ অপরাধের মামলায় রাজাকার মোফাজ্জল, আকরাম ও হাফিজারকে গ্রেফতার করে। 

শহীদ আব্দুস সোবাহান আকন্দের নাতী বলেন, আমার দাদা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ায় পাক হানাদার বাহিনী নির্মম ভাবে হত্যা করে। অথচ আজ পর্যন্ত সরকারী ভাবে স্বীকৃতি পায়নি। 

শহীদ অমুল্য কর্মকারের ছেলে সুরজীত কর্মকার বলেন, আমার বাবাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া সকল শহীদদের বিচার করতে হবে। তাহলে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। 

শহীদ আব্দুল কাদের সরকারের ছেলে শামছুল আলম সরকার বলেন, শহীদদের স্মৃতি বিজরিত স্থানগুলি যদি সংরক্ষন করা হয়। সেই স্থানে শহীদদের বিস্তারিত স্মৃতি তুলে ধরা হয়, তাহলে আগামী প্রজন্ম মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারবে। 

শহীদ পরিবারের আরেক সন্তান শাহ্ আলম সরকার বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের আত্মত্যাগ কোনদিন ভোলার নয়, তাই আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে প্রকৃত ইতিহাস। তিনি দেশের জন্য প্রান দিয়ে অবদান রাখা সকল বীর শহীদের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবী জানান। 

এবিষয়ে সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও তৎকালিন উপজেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম আজাদ বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালী জাতির মুক্তির লক্ষে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষন দিয়ে বাঙ্গালী জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরনা জুগিয়ে ছিলেন। এর পরে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে আপামর জনতা মহান মুক্তিযদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

এরপর মহিমাগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে বঙ্গবন্ধুর বিশাল জনসভা হয়েছিল। সেই জনসভার পূর্বে এমাদ উদ্দিন আকন্দের বাড়ীতে পায়ে হেটে বঙ্গবন্ধু খাওয়া দাওয়া করেছিলেন। এসময় এমাদ উদ্দিন আকন্দের সাথে আব্দুল কাদের সরকার ও সোবহান আকন্দ জনসভার সার্বিক সহযোগীতা করেছিলেন। সেসময় কুখ্যাত রাজাকার ব্লাক মজিদ পাকিস্থানীদের নেতৃত্ব দিতেন।

তিনি মনে করলেন, মহিমাগঞ্জে আমার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে হলে মাথা উঁচু করা এই ৩ ব্যক্তিকে হত্যা করতে হবে। এরি ধারাবাহীকতায় রাজাকার ও পাকহানাদার  বাহীনি মিলে এমাদ উদ্দিন আকন্দ, আব্দুল কাদের সরকার, সোবহান আকন্দকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। পরবর্তীতে আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইবুনাল এখানে এসে শহীদদের হত্যাকান্ডের সাক্ষ্য গ্রহন করে। এবং কয়েকজন রাজাকারকে গ্রেফতার করা হয়। তিনিও এই শহীদদের সরকারী স্বীকৃতি দেয়ার দাবী জানান। 

এবিষয়ে সাবেক উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা কাজী সাকোয়াত হোসেন বলেন, মহিমাগঞ্জের এমাদ উদ্দিন আকন্দ, আব্দুল কাদের সরকার ও সোবহান আকন্দ বটবৃক্ষের মত অনেক বড় মাপের মানুষ ছিলেন। তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে স্থানীয় ভাবে সার্বিক সহযোগীতা করেছিলেন। তাই রাজাকার পাকহানাদাররা মিলে তাদেরকে হত্যা করে।তিনি এই শহীদদের সরকারী ভাবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবী জানান।

সেই থেকেই স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও মুক্তিযোদ্ধারা দিবসটি উপলক্ষে দোয়া, স্মরনসভাসহ নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে পালন করে আসছে।